কাটা পড়া হাতটা ঢাকা শহরে ফেলে রেখেই
পটুয়াখালীর বাউফলের দাসপাড়া গ্রামে ফিরে যাচ্ছে
রাজীব। এই শহর তার হাত নিল, প্রাণ নিল। দরিদ্র
কোটায় আটকে পড়া ছেলেটার আশৈশবের সব
সংগ্রাম ব্যর্থ করে দিল। নিজের পায়ে দাঁড়াতে
ছুটে চলেছিল সে। তিতুমীর কলেজে স্নাতক
দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার পাশাপাশি কম্পিউটার কম্পোজ,
গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজ শিখছিল। ছাত্র পড়াত। দম
ফেলার ফুরসত ছিল না। ভাই দুটির দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছা
ছিল। হয়তো নিজের করে একটা স্বপ্নও ছিল। সব
শেষ।
হুমায়ূন আহমেদ এই নিম্নবিত্তের মৃদু মানুষদের সুখ-
দুঃখের অরূপকথার খবর রাখতেন। মুক্তিযুদ্ধে
বাবাকে হারানোর পর, সরকারি নিপীড়নে বাড়ি
হারানোর পর তিনি নিজেও কাটিয়েছিলেন অসম্ভব
দারিদ্র্যের এক যৌবন। তিনিই এঁদের মনের কথা
লিখেছিলেন, ‘আজন্ম সলজ্জ সাধ, একদিন আকাশে
কিছু ফানুস উড়াই’। কথাটা কাব্যিক শোনায়, কিন্তু এই
কাব্যের জন্ম দুঃখের নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল
কারাগারে। এমন কোনো স্বপ্ন যুবকেরা হৃদয়ে
পুষে রাখবেই। রাজীবেরও হয়তো এমন
কোনো সলজ্জ সাধ ছিল। তাই হাসপাতালের বিছানায়
শুয়ে অভিমান করে কাটা হাতের দিকে তাকিয়ে
বলেছিল, ‘রাজীব কে? রাজীব মারা গেছে!’
হাতের সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নটা মরে গিয়েছিল
বলে হয়তো ভেঙে পড়েছিল সে। তারপর সাত
দিন অচেতন থেকে চলে গেল।
কেন এতো কষ্ট পাচ্ছি জানি না। আপনারা কেউ কষ্ট
নিবেন না প্লিজ।
হাসপাতালে
প্রাণের রাজিব আর নেই
অনেক চেষ্টার পরও বাঁচানো গেলো না
কলেজছাত্র রাজীব হোসেনকে। দুই বাসের
রেষারেষিতে হাত হারিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ
(ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ
কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন থাকা রাজীব মারা
গেছেন।
সোমবার (১৬ এপ্রিল) দিনগত রাত ১২টা ৪০ মিনিটে
তাকে মৃত ঘোষণা করেন আইসিইউর চিকিৎসকরা।
প্রথমে
আইসিইউ’র চিকিৎসক ডা. রেজার বরাত দিয়ে বিষয়টি
জানিয়েছেন রাজীবের চাচা আল আমিন।
ঢামেক
পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) বাচ্চু মিয়াও
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আরো জানা গেল
রাজীবের অবস্থা সংকটাপন্ন বলে খবর পেয়ে
মধ্যরাতেই ঢামেকে ছুটে আসেন তার স্বজনরা।
তাদের মধ্যে আল আমিন ছাড়াও রয়েছেন
রাজীবের মামা জাহিদুল ইসলাম ও খালাতো বোন
রাবেয়া।
আল আমিন বলেন, চিকিৎসকরা আমাদের
জানিয়েছেন লাইফ সাপোর্টে থাকা রাজীবের
অবস্থার অবনতি হয় ১১টা ৩০ মিনিটে।
অব শেসে রাত ১২টা ৪০
মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পান্থকুঞ্জ
পার্কের সামনে বিআরটিসি বাসের সঙ্গে স্বজন
পরিবহনের বাস টক্কর দিতে গেলে বাস দু’টির চিপায়
পড়ে ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রাজীবের।
তিনি সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের
ছাত্র। তাকে তাৎক্ষণিক নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করা
হলেও পরদিন ঢামেকে নিয়ে আসা হয়। সেখানে
সরকারের তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলছিল।
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বাঁশবাড়ি গ্রামের
রাজীব তৃতীয় শ্রেণিতে থাকাকালে মাকে এবং
অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালে বাবাকে হারান। এরপর
মতিঝিলে খালা জাহানারা বেগমের বাসায় থেকে
এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন।
মহাখালীর
তিতুমীর কলেজে স্নাতকে ভর্তি হওয়ার পর
যাত্রাবাড়ীতে মেসে ভাড়ায় থেকে পড়াশোনা
করছিলেন রাজীব। এর পাশাপাশি তিনি একটি
কম্পিউটারের দোকানেও কাজ করছিলেন। নিজের
পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট দুই ভাইয়ের খরচও
চালাতে হতো রাজীবকে।
রাজীবের হাত বিছিন্ন করে ফেলার ঘটনায় দায়ের
করা মামলায় ৪ এপ্রিল বিআরটিসি বাসের চালক ওয়াহিদ
(৩৫) ও স্বজন বাসের চালক খোরশেদকে (৫০)
গ্রেফতার করা হয়।
৫ এপ্রিল দু’জনকে আদালতে
তোলা হলে তাদের দুই দিনের রিমান্ডে পাঠানো
হয়। ৮ এপ্রিল দু’জনকে পাঠানো হয় কারাগারে।
সোমবার দুই আসামির পক্ষ থেকে জামিন আবেদন
করা হলেও নামঞ্জুর করেন আদালত।
আমরা তার জন্য গভিরভাবে শোকাহত।
এবং তার আত্নার শান্তি কামনা করি। আমিন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন